বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাস

প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি বাঙালির জীবিকার উৎস। উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের অবস্থাও প্রায় অভিন্ন। কিন্তু প্রায় গোটা বাংলা পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতসহ তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং তাদের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা প্রসারিত পলিগঠিত সমভূমি হওয়ার দরুন প্রাচীনকাল থেকেই এখানে কৃষিকাজ অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল এবং এখানে কৃষির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল অত্যধিক। ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে শিল্পকর্ম, বিশেষত সুতিবস্ত্র উৎপাদন হ্রাসের ফলে এ চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। বস্ত্তত ১৯২১ সালের মধ্যে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় চার-পঞ্চমাংশ (৭৭.৩%) কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে, যা সমগ্র ভারতে ছিল ৬৯.৮%। ব্রিটিশ আমলে জনসাধারণ বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণিভুক্ত ছিল একদিকে বিভিন্ন পর্যায়ের খাজনা আদায়কারী ভূমিমালিক (জমিদার) ও নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী, অন্যদিকে রায়ত, বর্গাদার ও ক্ষেতমজুর। তবে রায়তরাই চাষাবাদে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। বাংলার দু অংশের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত ভূখন্ডেই কৃষির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল প্রকট।

প্রাচীন, মধ্যযুগ ও ব্রিটিশ আমলে কৃষি অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল উপখাত হিসেবে শস্য-উৎপাদনের অত্যধিক প্রাধান্য। কৃষির অন্য তিনটি উপখাত পশুসম্পদ, মৎস্য ও বন ছিল অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন। বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করা হতো এবং সরকারি প্রকাশনায় সংগ্রহের সময় অনুযায়ী এগুলি তিন শিরোনামে উল্লেখ করা হতো ভাদই (শারদ), খারিফ (হৈমন্তী) ও রবি (বাসন্তী)। এসব ফসলের মধ্যে ছিল ধান, পাট, গম, জোয়ার, যব, আখ, তামাক, তৈলবীজ, আলু, পিঁয়াজ, রসুন, আফিম, নীল, চা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ডাল, সুগন্ধি ও মসলা। ধান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনতম শস্যগুলির একটি। মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপিতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে ধানের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য কয়েকটি লেখায়ও এ শস্যের উল্লেখ রয়েছে কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ ও ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এবং ‘কাসাপালা’ ও ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ প্রভৃতি রচনায়।

সেন রাজত্বে বিশেষভাবে বিভিন্ন লিপিতে ধানক্ষেতের বিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়। লক্ষ্মণ সেনের অনুলিয়া তাম্রশাসনে হেমন্তে শালিধান কাটার উল্লেখ রয়েছে। একই লিপিতে আরও আছে যে, রাজা ব্রাহ্মণদের ধানীজমিসহ কয়েকটি গ্রাম দান করেন। ইদিলপুর তাম্রশাসনে ধানের আরেকটি উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে ধানকে সাধারণ অর্থে শালি বলা হয়েছে। আসলে, বাংলার বিভিন্ন সুপ্রাচীন জনপদ বঙ্গ, বরেন্দ্র, গৌড়, পুন্ড্রবধর্ন, রাঢ় ও সমতটে উৎপন্ন অনেকগুলি জাতের মধ্যে এটি সর্বোত্তম। প্রাচীন বাংলায় অন্যান্য বহু ফসল জন্মানোর উল্লেখও পাওয়া যায় যেমন তুলা, যব, সরিষা, আখ এবং কলাই ও মুগের মতো ডাল। তুলা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন বাংলায় তুলার চাষাবাদের কথা জানা যায়। এসব শস্য ছাড়াও বহু শাকসবজি ও ফলমূল উৎপন্ন হতো। খনার বচনে নিম্নোক্ত শাকসবজির উল্লেখ রয়েছে বেগুন, লাউ, মূলা, কচু, মরিচ, হলুদ, পটল। বিভিন্ন ধরনের ফলগাছ যেমন আম, কাঁঠাল, ডালিম, কলা, মহুয়া, খেজুর, লেবু, ডুমুর, তেঁতুল, নারিকেল প্রভৃতি প্রচুর জন্মাতো। পাল ও সেন রাজত্বকালের বহু লিপিতে আম ও কাঁঠালের উল্লেখ পাওয়া যায়।

খ্রিস্টীয় সাত শতকে বাংলা সফরকারী চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং পুন্ড্রবর্ধনে পর্যাপ্ত কাঁঠালের কথা লিখেছেন। লক্ষ্মণ সেনের গোবিন্দপুর তাম্রশাসনে ও কলকাতা সাহিত্য পরিষদের বিশ্বরূপ সেনের তাম্রলিপিতে এ ফলের উল্লেখ রয়েছে। পাহাড়পুরে পোড়ামাটির ফলকে প্রায়ই কলাগাছের ছবি দেখা যায়। চন্দ্র, বর্মণ ও সেন শাসনামলের শিলালিপি থেকে এটা স্পষ্ট যে, আট শতকের পর থেকে বাংলায় নারিকেলের ব্যাপক চাষ চলছিল। পান, সুপারি চাষও হতো। বারুই বা বারুজীবী নামে পরিচিত এক শ্রেণির লোকেরা পান চাষ করত। এসব ফসল ভারতের অন্যান্য অংশে রপ্তানি হতো। আরেকটি উপকরণ ছিল বাঁশ ঘরবাড়ি, ঝুড়ি ও রৌদ্রাবরক ছাদ তৈরীতে ব্যবহূত হতো। ‘রামচরিত’ গ্রন্থে বরেন্দ্রকে অশোক, কেশর, মহুয়া, কনক, কেতকী, মালতী, নাগকেশর ও পদ্মসহ অসংখ্য জাতের আকর্ষণীয় ফুলের স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভেষজ ফলবৃক্ষ, যেমন আমলকি, বহেড়া, হরীতকী এ ত্রিফলা প্রাচীন বাংলায় রোপণ করা হতো।
চাষাবাদ, পরিবহণ ও বিভিন্ন দুগ্ধজাত সামগ্রীর জন্য ব্যবহূত কৃষকদের মূল পশুসম্পদ ছিল গরু। গরুর সংখ্যা দিয়ে কখনও কখনও লোকের ধনদৌলতের পরিমাপ করা হতো। পাল ও সেন রাজাদের ভূদানের কতিপয় উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, চারণভূমিতে গবাদি পশুর জন্য বিভিন্ন ধরনের ঘাস জন্মাতো এবং এগুলি সাধারণত গ্রামের কাছাকাছি অবস্থিত থাকত। গ্রামবাসীরা কখনও কখনও যৌথভাবে রাখাল নিয়োগ করত, যে প্রতিদিন ভোরে মালিকের গরুর পাল বাথানে বা চাষজমির বাইরে পতিত জমিতে নিয়ে যেত এবং গোধূলিতে ফিরিয়ে আনত। খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল দুধ, দই, মাখন ও ঘি। গরুর হাড় সার তৈরিতে আর গোবর সার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহূত হতো। ভাস্কর্য, শিলালিপি ও সাহিত্যে উল্লিখিত অন্যান্য পশুর মধ্যে রয়েছে মহিষ, ঘোড়া, ছাগল, মেষ, হরিণ, বানর, শূকর, শিয়াল, সিংহ, বাঘ ইত্যাদি। সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির বিভিন্ন ধরনের মাছ মিলত প্রচুর এবং সেটা ছিল খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বিভিন্ন ছাপচিত্র ও লেখা থেকে প্রাচীন বাংলার ভূমির উর্বরতার প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। হিউয়েন-সাঙ জমিতে নিবিড় ও নিয়মিত চাষাবাদ লক্ষ্য করেন। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থের কিছু কবিতায় এ বর্ণনার সমর্থন মেলে। অবশ্য, সকল জমি উর্বর ছিল না এবং সেগুলি পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানিও পেত না, তাই সেসব জমিতে কৃত্রিম সেচের প্রয়োজন হতো। বিভিন্ন শাসক মহিপাল, রামসাগর, প্রাণসাগরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য জলাশয় সম্ভবত এজন্যই খনন করেছিলেন। ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহের নাগাল পাওয়ার জন্য কূপখনন কৌশলও লোকে জানত এবং নালায় বা খালে পানি সরবরাহের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করত। খালগুলি পানিতে উপচে ধানক্ষেত ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য পানি নিয়ন্ত্রণের কৌশলটিও তারা ভালই আয়ত্ত করেছিল। উইলিয়ম উইলকক্স (William Wilcox) এ প্রাচীন পদ্ধতিকে বলেছেন ‘উপচে-পড়া সেচ’ (overflow irrigation)। এসময় ব্যবহূত নানা ধরনের কৃষি হাতিয়ারের নাম বিভিন্ন লিখিত উৎস থেকে জানা যায়। এগুলি হচ্ছে লাঙলের ফাল, দা, কাস্তে, পাশি, পাচনবাড়ি ও ঢেঁকি। গ্রাম্য কামার ও কাঠমিস্ত্রিরাই এসব হাতিয়ারের অধিকাংশ তৈরি করত। বাংলায় প্রাপ্ত গুপ্তযুগের অধিকাংশ তাম্রশাসনে উল্লেখ রয়েছে যে, রাষ্ট্র বা রাজা নিজেই ভূমি বিক্রয় করত আর এটা ধর্মীয় কাজে দান করা হলে ভূমি মঞ্জুরি থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় আয়ের এক-ষষ্ঠমাংশ রাজাকে দিতে হতো। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভূমিক্রয়ের আবেদন স্থানীয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাজার নিকট পেশ করতে হতো এবং ধর্মীয় মঞ্জুরির ক্ষেত্রে রাজার অনুমতি বিশেষভাবে প্রয়োজন হতো, কারণ ভূমির সকল রাজকীয় পাওনা পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র রাজারই ছিল।

এভাবে প্রাচীনকালের যথাসম্ভব লব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় যে রাজা বা রাষ্ট্রই ছিল জমির মালিক। তৎকালীন ভূমির ব্যক্তি মালিকানার অস্তিত্বের কোনো কোনো প্রবক্তা এ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, অধিকাংশ শিলালিপিতেই উল্লিখিত জমি ছিল পতিত বা খিলা। কিন্তু ফরিদপুরে প্রাপ্ত তিনটি তাম্রশাসনে এবং অধিকাংশ পাল ও সেন শিলালিপিতে শুধু পতিত নয়, গোটা গ্রাম অনুদানেরও উল্লেখ রয়েছে। এসব গ্রামে নিশ্চিতই বসতবাড়ি এবং চাষাধীন জমিও থাকত। আবার লোকনাথের ত্রিপুরা অনুদানপত্রে বনভূমিতেও রাজার মালিকানার প্রমাণ রয়েছে। ভূমির রাজকীয় মালিকানার পক্ষে আরেকটি প্রমাণ হলো রাজা একটি মঞ্জুরি বাজেয়াপ্ত বা বাতিল করে অন্য কোনো ব্যক্তিকে সেটির মঞ্জুরি প্রদান করতে পারতেন। অবশ্য, রাষ্ট্র ভূমির মালিক হলেও গ্রামে বসবাসরত কৃষকদের দ্বারাই কৃষিব্যবস্থা পরিচালিত হতো এবং চাষাবাদ ছিল ব্যক্তিগত খামারভিত্তিক। কৃষিদ্রব্যে রাজার অংশভাগ ছিল রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু প্রাপ্ত উৎসগুলিতে বিভিন্ন নামের কর উল্লিখিত হলেও রাজস্ব ও অন্যান্য কর হিসেবে উৎপন্ন দ্রব্যের কতটা রাষ্ট্র আদায় করত তা জানা যায় না। ভূমি রাজস্বের অধিকাংশই দ্রব্যের হিসাবে নির্ধারিত হলেও কোনো কোনো ফসলের ক্ষেত্রে ভাগবাটোয়ারা কঠিন বিধায় সেটা নগদ অর্থে নির্ধারিত হতো। সম্ভবত হিরণ্য ছিল এ ধরনের একটি কর। কোনো কোনো স্থানে চাষে ব্যবহূত লাঙলের সংখ্যার হিসাবে কৃষকরা রাজকীয় পাওনা পরিশোধ করত।

বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা ও স্থানীয় লেখালেখি থেকে মধ্যযুগের কৃষির অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গতর তথ্যাদি পাওয়া যায়। বিদেশি পর্যটকগণ অবশ্য বাংলার মাটির উর্বরতা ও কৃষির অগ্রগতির উচ্চপ্রশংসা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে, ১৩৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দের এক চীনা পর্যটকের বর্ণনায় এ তথ্য পাওয়া যায় ‘স্বর্গের ঋতুগুলি পৃথিবীর ধনদৌলত সারা রাজ্যে ছড়িয়ে রেখেছে।’ প্রায় একই সময়ে ইবনে বতুতা পূর্ব বাংলা সফর করেন। তাঁর বর্ণনায় তিনি নদীপথে ১৫ দিন ধরে সিলেট থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণকালে ডানে ও বামে ফলবাগান, উন্নত পানিসেচ ব্যবস্থা, সমৃদ্ধ গ্রাম ও বাগবাগিচা দেখতে পান, ‘যেন আমরা একটি বাজারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি।’ শায়েস্তা খাঁর সময়ে বার্নিয়ার (Bernier) বাংলায় এসেছিলেন। তিনি পদ্মার উভয় তীরে বিভিন্ন যান্ত্রিক পানিসেচসহ ফসলের অত্যন্ত উর্বর মাঠ লক্ষ্য করেন। আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ‘ফসলের সামান্য ক্ষতি ছাড়াই একটি বিশেষ জাতের ধান একই বছরে তিনবার রোপণ ও কাটা হতো’। কিন্তু এটাকে ভূমির সাধারণ উর্বরতার একটি সূচক হিসেবে ধরা যায় না। এমনকি বিশ শতকের মাঝামাঝিও খুব কম জমিতেই বছরে তিনটি ফসল আবাদ করা গেছে।

কৃষির সমৃদ্ধি সম্পর্কিত সমসাময়িক তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুলতানি ও মুগল আমলে বাংলার কৃষির যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। অনেক স্থানের নামের সঙ্গে ‘আবাদ’ সংযুক্তি (যেমন, ফতেহাবাদ ও খালিফাবাদ) সেসব জায়গা চাষাধীনে আসার সাক্ষ্যবহ হতে পারে। তৎকালীন সরকার ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, বীজ ও বলদ বা কৃষির যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ক্রয়ে সহায়তার জন্য সরকার কৃষকদের তাকাবি ঋণ দিত। পতিত জমি আবাদে উৎসাহ দানের জন্য কৃষকদের কম খাজনায় জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি করে শেষ পর্যন্ত পুরো খাজনা আদায় করা হতো। সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপের পিছনে মূল কারণ ছিল চাষাবাদের সম্প্রসারণ অর্থাৎ সরকারি আয়ের মূল উৎস ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি। অবশ্য, কৃষি সম্প্রসারণে মূল ভূমিকা পালন করেছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে মধ্যযুগে ফসলি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির হিসাব জানা যায় নি। কিন্তু মুগল আমলে (১৫২৬-১৭০৭ খ্রি) বাংলার কতিপয় অংশে (মুগল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও) ফসলি জমির পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার ধারণাটি ইরফান হাবিব প্রশ্নসাপেক্ষ মনে করেন।

প্রাচীনকালের মতো মধ্যযুগের প্রধান কৃষিপণ্য ছিল ধান। এটি এত উৎপন্ন হতো যে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর রপ্তানির জন্যও যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকত। মোটামুটি তিন ধরনের ধান চাষ হতো। এগুলি আউশ (হেমন্ত), আমন (শীত) ও বোরো (গ্রীষ্ম)। এ তিন ধরনের প্রত্যেকটির মধ্যে বহু প্রকারভেদ ছিল এবং এগুলির অনেক নাম ‘শূন্যপূরাণ’ ও ‘শিবায়ন’ সহ সমসাময়িক উৎসসমূহে উল্লিখিত আছে। অবশ্য, শূন্যপূরাণ অনুসারে ধানের সহস্রাধিক প্রকারভেদ ছিল। প্রত্যেক জাতের ধানের একটি করে দানা সংগ্রহ করা হলেও একটি বড় পাত্র ভরে যাবে বলে মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল যে মন্তব্য করেছিলেন উপরিউক্ত তথ্যে তার দৃঢ় সমর্থন মেলে। এ বর্ণনা অতিরঞ্জিত নয়। বিশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক প্রদর্শনীতে প্রকৃতপক্ষে ধানের সহস্রাধিক প্রকারভেদ প্রদর্শিত হয়। আবুল ফজল একটি বিশেষ জাতের ধানের বর্ণনা দিয়েছেন যা পানির গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পায়, ফলে পানি ফসলের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এখানে তিনি সম্ভবত বন্যাপ্রবণ নিচু এলাকার বোনা আমন ধানের অর্থাৎ জলিধানের কথা উল্লেখ করে থাকবেন। আমনের একটি শীতকালীন প্রকারভেদও আছে আর এটি হল রোপা আমন।

তুলা ও তুঁত ছিল প্রদেশের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমুখী ফসল। প্রসঙ্গত, সুতা ও রেশম ছিল বাংলার প্রধান শিল্প। পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তুলা উৎপন্ন হতো। পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত তুলা জন্মাত বীরভূম, বর্ধমান ও নদিয়া জেলায় আর উত্তরবঙ্গে প্রধানত রংপুর, মালদহ ও দিনাজপুর জেলায়। অবশ্য, বিখ্যাত মসলিন শিল্পের উপযোগী অতি উন্নতমানের তুলা ফলত ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায়। জন টেলর নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক এজেন্ট ১৮০০ সালের দিকে উল্লেখ করেন যে, ঢাকা শহরের চারপাশে ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী স্থানে ‘পৃথিবীর যে কোনো অংশের তুলনায় সর্বোত্তম মানের’ তুলা (কার্পাস) উৎপন্ন হয়। টেলর আরও লিখেছেন যে, তুলার বীজ বোনা হতো অক্টোবর-নভেম্বরে এবং ফসল তোলা হতো এপ্রিল-মে মাসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সুতি বস্ত্রশিল্পের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তুলার চাষও প্রকৃতপক্ষে বন্ধ হয়ে যায়। রেশমপোকার জন্য তুঁতগাছ জন্মাত মধ্য ও উত্তরবঙ্গে, বিশেষত মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী জেলায়। খুব সম্ভব ফসলটি চীন থেকে প্রবর্তিত হয় এবং পনেরো শতকে বাংলায় একজন চীনা পর্যটকের বর্ণনায় প্রথমবারের মতো রেশমের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবুল ফজল, টেভার্নিয়ার ও বার্নিয়ার-এর লেখা এবং ইংরেজ কারখানার নথিপত্রেও প্রদেশে তুঁতচাষের উল্লেখ দেখা যায়। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে কাসিমবাজার সফরকারী টেভার্নিয়ার উল্লেখ করেন যে, কাশিমবাজারে রেশমের বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায় ২৫ লক্ষ পাউন্ডের সমপরিমাণ যার একাংশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হতো।

আরেকটি বাণিজ্যিক ফসল ছিল ইক্ষু। ১৭৫৬ সাল পর্যন্তও বাংলার চিনির একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য চালু ছিল মাদ্রাজ, বোম্বে, মালাবার উপকূল, সুরাট, সিন্ধু, মাসকাট, মক্কা ও জেদ্দার সঙ্গে। এমনকি সতেরো শতকের মাঝামাঝিও বিপুল পরিমাণ চিনির রপ্তানি বাণিজ্যসহ বাংলা ছিল এ শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। বারবোসা, বারথেমা ও বার্নিয়ার বিবরণী এবং ইংরেজ ও ওলন্দাজ নথিপত্রে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। এতে বোঝা যায় যে, ইক্ষু মধ্যযুগের বাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ছিল। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পায় এবং উৎপন্ন চিনি তখন কেবল প্রদেশের নিজস্ব চাহিদা মেটাতে পারত। জমির একটি নির্দিষ্ট অংশে একাধিক জাতের সরিষা ও অন্যান্য তৈলবীজের মতো বাণিজ্যিক ফসল ফলানো হতো। এ সময় প্রদেশে কিছু নতুন শস্য প্রবর্তিত হয় তামাক, ভুট্টা ও সম্ভবত নীল। একইভাবে, তিনটি নতুন ফল- কাজুবাদাম, আনারস ও পেঁপে পাশ্চাত্য থেকে এসে পৌঁছায়। মিষ্টিআলু ও সাধারণ আলু এ সময়ই প্রবতির্ত হয়। এভাবে, বাঙালি কৃষকরা শুধু বহুবিধ শস্য চাষই নয়, নতুন শস্য গ্রহণেও উৎসাহী হয়। এ ছাড়া, সমসাময়িক বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, নদ-নদী, শাখানদী, হাওর, বিল, পুকুর ও সমুদ্রে ছিল বিভিন্ন ধরনের প্রচুর মাছ।

মধ্যযুগে ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর হিসেবে সরকার কৃষিদ্রব্যের কতটা আদায় করত সে সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। চতুর্দশ শতকে এ প্রদেশ সফরকারী ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন যে, ‘নীল নদীর’ তীরের গ্রামবাসীরা অন্যান্য উপকরণসহ ভূমিকর হিসেবে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের অর্ধেক প্রদান করত। ওয়াং-তে-উয়ান (Wang-ta-Yuan) ওই সময়ের এক লেখায় বলেছেন যে, মধ্যযুগে রাষ্ট্র মোট উৎপন্ন দ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ কর হিসেবে আদায় করত। জমির উৎপাদিকা শক্তি ও ফসলের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্বের হারে পার্থক্য হয়ে থাকে এটা মনে রাখলেই এ আপাত অসামঞ্জস্য সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। এভাবে সুলতানি আমলে কৃষিদ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত রাজস্বের ভিন্ন ভিন্ন হার চালু ছিল। আকবরের সময় নির্দিষ্ট হার ছিল উৎপন্ন দ্রব্যের এক-তৃতীয়াংশ। মুর্শিদকুলী খাঁর আমলেও এ হার অব্যাহত থাকে। অবশ্য, ভূমি রাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য পল্লীকরও ছিল এবং উল্লেখ করা হয় যে, ভারতবর্ষে এসব অতিরিক্ত করের পরিমাণ ছিল মোট ভূমি রাজস্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তাই বলা যায়, মধ্যযুগের বাংলায় যে কোনো নির্দিষ্ট মান বিবেচনায় রাজস্ব হার ছিল অত্যধিক।
নির্ধারিত হারে প্রতি একক পরিমাণ ভূমির জন্য অথবা গোটা গ্রামের জন্য এককালীন হিসেবে রাজস্ব ধার্য করা হতো। কোনো কোনো স্থানে লাঙলের সংখ্যার ভিত্তিতে ভূমি রাজস্ব ধার্যের প্রথা চালু ছিল। ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর নগদ অর্থে পরিশোধ করা হতো। অর্থাৎ কৃষকদের উৎপন্ন কৃষিদ্রব্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিক্রয় করতে হতো। অন্যদিকে পণ্যোৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামবাসীরা অর্থকরী ও খাদ্যশস্য শহরের বাজারে বিক্রয় করত, কিন্তু বিনিময়ে তেমন কিছুই কিনত না। কেননা গ্রামবাসীদের প্রয়োজনীয় সকল অ-কৃষিদ্রব্য গ্রামেই উৎপন্ন হতো। এটা বলা যায়, মধ্যযুগে প্রত্যেকটি গ্রামই স্বনির্ভর ছিল। জমিদার বলে অভিহিত বিভিন্ন সংখ্যা ও মর্যাদার সচরাচর বংশানুক্রমিক মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণি ও ‘আমিল’ হিসেবে পরিচিত কর্মচারীদের সহযোগিতায় ভূমি রাজস্ব আদায় করা হতো। সুলতানি ও মুগল আমলে সাধারণভাবে কৃষকদের পাট্টা দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। কবিকঙ্কনের ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’ গ্রন্থে উপকথাখ্যাত প্রজাবর্গের যথাক্রমে ইন্দ্র ও কালকেতুর কাছ থেকে বন্দোবস্ত পাট্টা গ্রহণের ঘটনা বর্ণিত আছে। প্রজা ছিল দু’ধরনের খুদকাস্ত ও পয়কাস্ত। গোড়ার দিকের ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা প্রথম বর্গের প্রজাদের বলত স্থায়ী চাষি। দ্বিতীয় বর্গের চাষিরা অস্থায়ী ভিত্তিতে জমিচাষের জন্য অন্যান্য গ্রাম থেকে আসত এবং তারা খুদকাস্ত চাষীদের চেয়ে সাধারণত কম খাজনা দিত।

চাষাবাদ পদ্ধতি এবং কৃষির যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ছিল প্রাচীন যুগের মতোই। এ সময় বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল চাষাবাদ পদ্ধতির দিক থেকে একমাত্র ব্যতিক্রম। সেখানে প্রচলিত জুমচাষ আজও চালু রয়েছে। কুয়া থেকে পানি তোলার পদ্ধতি তখনও উন্নত হয় নি। তৎকালীন উত্তর-ভারতে প্রবর্তিত ‘পারস্য হুইল’ বাংলায় পরিচিত ছিল না। জমিতে সার প্রয়োগ পদ্ধতিও সম্ভবত অনুরূপ ছিল। ফলে, মুগল আমলে গুরুত্বপূর্ণ শস্যের ফলন উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতক বা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। ওই সময় অধিক উর্বর জমি চাষাধীনে আনার জন্য শস্যের ফলন হার অধিক হতে পারে এ যুক্তি দেখানো চলে। কিন্তু একথাও বলা যায় যে, জমি-মানুষ অনুপাত অধিকতর অনুকূল থাকায় স্বল্পনিবিড় চাষাবাদ অনুসরণ করা হতো। অনুকূল জমি-মানুষ অনুপাত থেকে বোঝা যায় যে, মধ্যযুগের বাংলায় মাথাপিছু উৎপাদন অপেক্ষাকৃত অধিক ছিল। মধ্যযুগে কৃষিদ্রব্যের নিম্নমূল্য যা বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা কৃষিদ্রব্যের প্রাচুর্যের সূচক হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে।

ফসল উৎপাদন কখনও অতিবৃষ্টি, কখনও বা অনাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। প্রদেশের কোনো কোনো স্থানে মাঝে মাঝে সম্ভবত দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি বিরাজ করত। দ্বিতীয়ত, কৃষকশ্রেণীর মধ্যে নির্দিষ্টমাত্রার অসাম্য বিদ্যমান ছিল। একদিকে একশ্রেণীর গ্রামীণ পরিবারের এত বেশি জমি ছিল যে কেবল পারিবারিক শ্রমে সেগুলি চাষাবাদ সম্ভব হতো না, অন্যদিকে আরেক শ্রেণির কোনো জমিই ছিল না বা থাকলেও খুবই সামান্য। এ থেকে বোঝা যায় যে, গ্রামীণ পরিবারগুলির একাংশ কৃষিশ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করত। তাই মাথাপিছু গড় উৎপাদন অধিক থাকলেও বণ্টন ছিল অসমান। তৃতীয়ত, কৃষকদের ওপর রাষ্ট্রের দাবি ছিল অত্যধিক, মোট উৎপন্নের প্রায় ৪০%। পরিশেষে, কৃষিসংশ্লিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কৃষিদ্রব্যের যোগান পর্যাপ্ত থাকলেও জীবনযাত্রার সার্বিক মান সন্তোষজনক ছিল না। বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা ও স্থানীয় সূত্রের প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবুল ফজল জানান যে, বাংলার সাধারণ মানুষ শুধু কোমরে লুঙ্গি গুঁজে গোটা শরীর প্রায় উদোম রাখত। জলবায়ুগত বা সামাজিক প্রথার জন্য এমনটি ঘটত তা স্বীকার্য নয়। পরিধেয় বস্ত্রের ধরন ও মান থেকেই উচ্চশ্রেণীকে পৃথক করা যেত। সেসময়ে বাংলায় তুলা উৎপাদন ও তাঁতের প্রচলন অত্যন্ত ব্যাপক ছিল। ধান-চালের তুলনায় কাপড় ছিল মহার্ঘ। জুতার ব্যবহার ব্যাপক ছিল না এবং মোরল্যান্ডের মতে, চামড়ার উচ্চমূল্যের জন্যই এটি ঘটত। অধিকাংশ কৃষক খড়ে ছাওয়া মাটির এক কামরার ঘরে থাকত। চৌকি ও বাঁশের চাটাই ছাড়া কৃষকদের ঘরে অন্য কোনো আসবাবপত্র তেমন মিলত না। কাঁসা বা তামার তৈজসপত্র যথেষ্ট দামী হওয়ায় জনসাধারণ সাধারণত সেগুলি ব্যবহার করত না। তাই কৃষি উৎপাদনের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বাংলার কৃষকরা উচ্চমানের জীবনযাপন করত তেমন নিদর্শন পাওয়া সত্যিই কঠিন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষিখাতের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে। প্রধানত আবাদি এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের মোট পরিমাণ ও মূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু, ভারত শিল্পপণ্য থেকে কৃষিপণ্য সরবরাহকারী হিসেবে নিজ ভূমিকা পরিবর্তন করায় এবং নির্দিষ্ট কিছু শিল্প ও নগর কেন্দ্র উন্নয়নের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায়, অতীতের চেয়ে বাজারের জন্য উৎপাদন আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অবনতি ও জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে এসময় কৃষিখাতের ওপর বর্ধিত (জনসংখ্যার) চাপ সত্ত্বেও এমনটি ঘটেছিল। বাংলাতেই বাজার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা প্রথম অনুভূত হয়, কারণ এটিই প্রথম ব্রিটিশের শাসনাধীন হয়েছিল।

আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আবাদযোগ্য পতিত জমি ছিল। এটি থাকার গুরুত্বপূর্ণ কারণ ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ প্রদেশের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক জনহানি ঘটায়। কিন্তু পরবর্তী শতকে ফসলি এলাকা দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে এটি বস্ত্তত শেষসীমায় পৌঁছায় (চাষাবাদ সম্প্রসারণের আর তেমন সুযোগ ছিল না)। অবশ্য, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডেই মূলত তৎকালীন চাষাবাদ সম্প্রসারণ কেন্দ্রীভূত ছিল। এভাবে, উনিশ শতকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর বৃহত্তর অংশ, ত্রিপুরাসহ (বর্তমান কুমিল্লা জেলা) মেঘনা মোহনার অধিকাংশ, বরেন্দ্র অঞ্চল, সুন্দরবন ও উত্তর-পূর্ব বাংলার হাওর এলাকা পুরোপুরি চাষাবাদের আওতায় আসে। ২৪ পরগনা, খুলনা ও বাকেরগঞ্জে তিন জেলার কৃষক সুন্দরবন অঞ্চল পুনরুদ্ধারে অংশ নেয়। চাষাবাদের নতুন নতুন এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার আদমশুমারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়। অবশ্য, সুন্দরবন আবাদ করে এসব জেলায় চাষাবাদ সম্প্রসারণ প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অধিক মাত্রায় হচ্ছিল। মাটির অধিক উর্বরতার ফলে সেখানে একজন প্রজার পক্ষে অন্য যে কোনো স্থানের চেয়ে বৃহত্তর এলাকা চাষাবাদ সম্ভব হতো। অধিকন্তু, চাষাবাদের একটি বড় অংশ করত অনাবাসিক প্রজারা যারা সেখানে মৌসুমের জমিচাষের পর নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করত। পুনরুদ্ধারের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল এসব জেলায় নদীগুলিতে অনবরত জেগে ওঠা উর্বর পলিময় জমি। বাকেরগঞ্জ জেলায় এ সুযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল। ত্রিপুরা জেলার বিশাল চরাঞ্চল এসময় চাষাধীনে আনা হয়। সমগ্র পূর্ববঙ্গে নতুনভাবে গড়ে ওঠা এসব কৃষিবসতি ছাড়াও সেখানে কয়েকটি জেলার নিজস্ব বিশেষ আবাদযোগ্য অঞ্চল ছিল। ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায় এ ধরনের অঞ্চল ছিল প্রায় জনশূন্য মধুপুর জঙ্গল। দিনাজপুরের দক্ষিণের এক-তৃতীয়াংশ, পূর্ব-মালদহের অর্ধাংশ, পশ্চিম-বগুড়ার অর্ধাংশ ও রাজশাহীর উত্তরের এক-চতুর্থাংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চলের জমি অভিবাসী সাঁওতাল শ্রমিকদের দ্বারাই আবাদ সম্ভব হয়েছিল।

অবশ্য, পশ্চিম ও মধ্য বাংলার কিছু অংশে অবস্থা ছিল ভিন্নতর। এখানে বহুকাল থেকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নদীব্যবস্থার একটি অবক্ষয় চলছিল। দূরবর্তী গ্রামসমূহকে রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য রেলপথ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে এ অবক্ষয় তৎকালে ত্বরান্বিত হয়। ফলে দুটি প্রতিকূল প্রভাব দেখা দেয় ভূমির উৎপাদশীলতা হ্রাস এবং ম্যালেরিয়ার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। শেষোক্ত কারণে লোকবৃদ্ধির হার হ্রাস পায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নদীয়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, হুগলি, যশোরের মতো জেলাগুলিতে আবাদি এলাকা কমে যায় বা অপরিবর্তিত থাকে। প্রদেশের দুটি অংশ ক্ষয়িত ও সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে উৎপাদন ক্ষমতার পার্থক্য থাকলেও বাংলায় সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল পরিমাণগতভাবে এবং মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থমূল্যেও। উনিশ শতকে পূর্ব বাংলার জেলাসমূহে বিভিন্ন ফসলের ফলনের হারে কোনো উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল না।

উনিশ শতকে শস্য উৎপাদনের উল্লিখিত বর্ণনার ভিত্তি হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিক মূল্যায়ন এবং প্রতি দশ বছরে আদমশুমারি জনসংখ্যার পরিসংখ্যান, কিন্তু ফসলি জমি ও একর প্রতি ফলনের কোনো কালানুক্রমিক তথ্য নয়। সরকার এধরনের তথ্য সরবরাহ শুরু করে কেবল ১৮৯১/৯২ সালের পর থেকে। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রকাশনা হলো Estimates of Area and Yields of Principal Crops in India, Agricultural Statistics of India, Agricultural Statistics of Bengal, Season and Crop Report। এসব পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সরকারিভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গের কোনো কোনো জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল বা হ্রাস পাওয়া অব্যাহত ছিল। পক্ষান্তরে, পূর্ববঙ্গের জেলাসমূহে আবাদি জমির পরিমাণ প্রান্তিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে (বিশেষত দুফসলি চাষ বিস্তারের ফলে)। কিন্তু বৃদ্ধিহার এসময় এতই প্রান্তিক ছিল যে সার্বিক বিন্যাসে বদ্ধাবস্থা ধরা পড়ে। একক ফসলগুলির মধ্যে পাটের জমি কিছুটা বাড়লেও ধানের (মোট ফসলি জমির ৮০%) ক্ষেত্রে বদ্ধাবস্থা সার্বিক প্রবণতার নির্ধারক ছিল। সরকারিভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৪১ সালের পর খাদ্যশস্যের চাষাধীন জমির পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এটা ছিল তখন কয়েক বছর ধরে সরকার পরিচালিত ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ প্রচারাভিযানের অবদান। অবশ্য, এ অভিযানের যতটা সাফল্য দাবি করা হয়েছিল আসলে তা হয়ত ততটা ছিল না। শস্যের ফলন হারে কী কী প্রবণতা লক্ষনীয় ছিল? প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যাবে যে, পাট ও ইক্ষুর ফলন বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু আমন ধানের ফলন হার বৃদ্ধি পায় নি। অর্থাৎ সামগ্রিক ফলন হারে স্থবিরতা বিরাজমান ছিল। যাবতীয় ফসলের ফলন হার ও আওতাধীন জমির পরিমাণের স্থবিরাবস্থা থেকে বোঝা যায় যে, সামগ্রিক ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায় নি। এটি এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছিল যখন বার্ষিক ১% হারে বাড়ছিল জনসংখ্যা। বিশ শতকের শুরুতে অত্যধিক জন ঘনত্বের দরুন মাথাপিছু ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল, অর্থাৎ গড়পড়তা জোতজমি ছোট হয়ে (প্রায় ৪ একর) পড়েছিল। এসময় শস্য উৎপাদনের স্থবিরতার ফলে মাথাপিছু উৎপাদন আরও হ্রাস পেয়েছিল।

ইতোমধ্যে ১৮৮৫ সালে একটি প্রাদেশিক কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কৃষি উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাতে ছিল ১. বর্ধমান, ঢাকা, রাজশাহী, শিবপুর ও রংপুরে পরীক্ষামূলক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা; ২. প্রদর্শক (ডেমোনেস্ট্রেটর) নিয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের উন্নত চাষপদ্ধতি প্রদর্শন; ৩. কৃষিবিষয়ক লেখা প্রকাশের মাধ্যমে কৃষকদের বিভিন্ন পরীক্ষণের ফলাফল জানানো; ৪. কৃষকদের উন্নততর বীজ সরবরাহ; ৫. কৃষক সন্তানদের উন্নত চাষপদ্ধতির প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ৬. উন্নত কৃষি হাতিয়ার প্রবর্তন। কিন্তু খামার পর্যায়ে এসব উদ্যোগের প্রভাব ছিল খুবই সীমিত। ফলে চাষাবাদ পদ্ধতি এবং কৃষির যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার প্রায় মধ্য ও প্রাচীন যুগের মতোই সেকেলে থেকে যায়। বাণিজ্যিক সার অজ্ঞাত ছিল। উন্নত জাতের বীজ ব্যবহারে সামান্য অগ্রগতি ঘটে। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের শেষের দিকে মাত্র ৬% ধানী জমিতে উন্নত বীজ বপন করা হতো। মোট ফসলি জমির একটি ক্ষুদ্রাংশে সেচব্যবস্থা চালু ছিল এবং শুধু পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় জেলায় তা সীমিত ছিল। এদিকে পূর্ববঙ্গের জেলাসমূহে দুফসলি জমি বৃদ্ধির ফলে পতিত জমি হ্রাস পায়। অতঃপর প্রধান প্রধান শস্যের একর প্রতি ফলনের স্থবিরতার কারণগুলি আর প্রচ্ছন্ন থাকে না।

ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে কৃষি উৎপাদন শুধু পরিমাণ ও মূল্যের দিক থেকেই বৃদ্ধি পায় নি, অধিকতর বাণিজ্যিক বা বাজারমুখীও হয়েছিল। নতুন না হলেও বাণিজ্যিকীকরণ এসময় কৃষি-অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। বিক্রয়ের জন্য উৎপাদন শুধু অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রেই সীমিত থাকে নি, এক পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী (Report on the Marketing of Rice in India) উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের শেষের দিকে বাংলায় উৎপাদিত মোট ধানের শতকরা ৪৪ ভাগ বাজারজাত হতো। অবশ্য, অর্থকরী ফসলের আবাদও বৃদ্ধি পায় এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, বিশেষত পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের কতিপয় জেলায় (ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রংপুর)। পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ বৃদ্ধির সময় এতে মোট কৃষিশ্রমের ১০ শতাংশের কর্মসংস্থান জোটে, পাট ব্যবসায় বিভিন্ন মধ্যগ শ্রেণি সম্পৃক্ত হয়, কলকাতায় মিলমালিক ও রপ্তানিকারক মুনাফা অর্জন করতে থাকে, যথেষ্ট সংখ্যক শিল্পশ্রমিক গড়ে ওঠে এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৃষিখাতে বিপুল পরিমাণ বাজারজাত উদ্বৃত্ত দেখা দেয়। এক হিসাব অনুযায়ী, বাজারজাত উদ্বৃত্তে পাটের অংশভাগ ছিল ১৯২০/২১ সালে ২০% থেকে ১৯২৫/২৬ সালে ৬৪%, ১৯২০/২১-১৯৩২/৩৩ সালে গড় উদ্বৃত্ত ছিল ৪০%, যেখানে ধানের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৪%।

পাট ছিল একটি রপ্তানি ফসল কাঁচা ও শিল্পপণ্য। পাটজাত পণ্যের মধ্যে ছিল চটের ব্যাগ ও প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার্য চটের কাপড়। এভাবে বৈদেশিক চাহিদাই পাট উৎপাদন বৃদ্ধির পিছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৮৫৫ সালে এবং পরবর্তী ৫০ বছরে আরও ৩৪টি পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০০/০১ সালে এসব কলের উৎপাদন প্রক্রিয়ার ছিল ৩,১৫,০০০ টাকু ও ১৫,৩৪০ তাঁত এবং এগুলিতে নিয়োজিত ১ লক্ষ ১০ হাজার শ্রমিক, ব্যবহূত হতো মোট উৎপন্ন ফসলের প্রায় ৪০%। ইতোমধ্যে ডান্ডি মিলগুলিতে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং ১৮৯৬/৯৭ সালের দিকে পাট চাষাধীন জমি ১৮৭৬/৭৭ সালের মাত্র ৫ লক্ষ ৫৩ হাজার একর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ লক্ষ একরে দাঁড়ায়। ১৯২০-৪৭ সময়কালে পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ ছিল মোট ফসলি জমির ১০% এবং তা শীর্ষে পৌঁছে ১৯০৪/০৫-১৯০৭/০৮ সালে, যখন ৩০ লক্ষাধিক একর জমিতে পাট ফলত। পাট চাষাধীন জমি অতঃপর তেমন হ্রাস পায় নি, এমনকি মন্দার বছরগুলিতেও, যখন দাম খুব কমে গিয়েছিল। দুটি পাট অনুসন্ধান কমিটি (Finlow committee and Fawcus Committee) যথার্থই চিহ্নিত করেছিল যে, এটি ঘটেছিল একটি লাভজনক বিকল্প ফসলের অনুপস্থিতির জন্যই।

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার কৃষিকে আভিজাত্যিক কাঠামো দিয়েছিল। এ ব্যবস্থায় জমিদারদের জমির স্বত্বাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সরকার তাদের ওপর ধার্যকৃত খাজনা চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। এতে আরও শর্ত থাকে যে, অতঃপর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাতে খাজনা মওকুফ বা স্থগিত দাবি করার কোনো অধিকার স্বত্বাধিকারীদের থাকবে না এবং কোনো স্বত্বাধিকারী নির্ধারিত তারিখের মধ্যে যথারীতি খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার জমিদারির সম্পূর্ণ বা অংশত বিশেষ নিলামে বিক্রি হবে। খাজনা বিক্রয় আইনের (সূর্যাস্ত আইন বলে পরিচিত) কঠোর প্রয়োগের ফলে অনেক জমিদারি নিলামে বিক্রি হয়ে যায় এবং পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং সরকারি ও জমিদারি কাজে নিয়োজিত এক শ্রেণির লোক নতুন জমিদার হয়ে ওঠে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের একটি উদ্দেশ্য ছিল এ যে, জমিদারদের ওপর সরকারের দাবি অপরিবর্তিত থাকায় তারা কৃষি উন্নয়নে মূলধন নিয়োগ করবে। লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তিগত সম্পদের জাদুস্পর্শ এদেশের জমিদারদেরও ব্রিটিশ সহযাত্রীদের অনুসরণে প্রেরণা যোগাবে। কিন্তু এ প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। পুরানো বা নতুন জমিদার কেউই কৃষিতে মূলধন বিনিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেয় নি।

জমিদার বা মূল স্বত্বাধিকারী ও বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও গোটা একপ্রস্থ আবওয়াবের (অবৈধ উপকর) আকারে কৃষি উদ্বৃত্তের একটি বিরাট অংশ আত্মসাৎ করত। ১৭৯৩ সাল থেকে দুভাবে এ উদ্বৃত্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে- খাজনার বর্ধমান হার এবং অতিরিক্ত ভূমি চাষাধীনে আনা। কিন্তু রাষ্ট্রের চাহিদা ছিল বাঁধা। একটি তথ্য থেকে এ বৃদ্ধির মাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এক হিসাব অনুযায়ী ১৯১৮/১৯ সালে এসব স্বত্বাধিকারী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মোট খাজনা ১২.৮৫ কোটি টাকার ৭৬.৭% আত্মসাৎ করেছিল, আর ভূমিরাজস্ব হিসেবে রাষ্ট্রকে দিয়েছিল মাত্র ২.৯৯ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে উল্লেখ ছিল যে আদায়কৃত মোট খাজনার ৯০% কোষাগারে যাবে এবং জমিদাররা পাবে মাত্র ১০%। খাজনা ও রাজস্বের এ ফাঁকের সুবাদে স্বত্বাধিকারী ও মধস্বত্বভোগীরা একটি বর্ধিষ্ণু মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণির (ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত) ভিত্তি স্থাপন করে যা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল আইন, সাংবাদিকতা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সিভিল সার্ভিস ও বিচার কাজে নিয়োজিতদের প্রথম সফল প্রজন্ম। কিন্তু জমিদাররা এ উদ্বৃত্তের একাংশ কৃষি উন্নয়নে বিনিয়োগ করে নি। এখানেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা নিহিত। এতে কৃষিউদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা পালন না করেই জমিদাররা এ উদ্বৃত্ত ভোগ করার সুযোগ পায়। ভূমি পুনরুদ্ধারে সহায়তা যুগিয়ে পতিত জমি আবাদ ভূমিস্বত্ব কিছুটা উৎপাদনশীল ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্ত, বিশ শতকের প্রথম দিকে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বস্ত্তত থেমে গেলে মূল মালিকসহ অন্যান্য সমগোত্রীয়দের মতো এ মধ্যস্বত্বভোগীরাও পরজীবীতে পরিণত হয়। প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক ১৯৩৮ সালে নিযুক্ত ‘বেঙ্গল ভূমি-রাজস্ব কমিশন’ (ফ্লাউড কমিশন হিসেবে পরিচিত) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের সুপারিশ করে। অবশ্য, ব্রিটিশ শাসনের অবশিষ্ট বছরগুলিতে আর সুপারিশটি বাস্তবায়িত হয় নি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনে রায়তের অধিকার কখনও সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত হয় নি। অন্যদিকে, ১৭৯৯, ১৮১২, ১৮২২ ও ১৮৪৪ সালের বিধিবিধানের মাধ্যমে তাদের অবস্থান দুর্বলতর করা হয়েছিল। এসব বিধিবিধানের সুবাদেই জমিদারদের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, কৃষকদের ওপর বর্ধিত হারে খাজনা চাপানো হয় এবং ভূমিস্বত্বে চরম নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। অতঃপর ১৮৫৯ সালের শুরু থেকে প্রজাদের অবস্থা উন্নয়নে বেশ কিছু আইনগত পদক্ষেপ গৃহীত হলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ রায়তরা প্রকৃতপক্ষে মালিকানার সকল অধিকার- উত্তরাধিকার, ভূমির অবাধ হস্তান্তর, উচ্ছেদ ও খাজনাবৃদ্ধির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা লাভ করে। এমনকি রায়তদের অধীনস্থ তস্য-রায়তরাও কতিপয় আইনগত অধিকার পায়। বর্গাদার বা ভাগচাষিদেরও কতিপয় অধিকার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় (উৎপন্ন ফসলে সাধারণত তাদের অংশভাগ ছিল ৫০%), কিন্তু সম্ভবত প্রাদেশিক আইন পরিষদে ধনী কৃষক ও জমিদারদের প্রতিনিধিদের বিরোধিতার কারণে উদ্যোগটি সফল হয় নি। এভাবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিকে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে। একদিকে ছিল খাজনা আদায়কারী একশ্রেণীর জমিদার ও বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং অন্যদিকে জমির ‘মালিক’ চাষিগণ। একটি নির্দিষ্ট স্তরের যে মধ্যস্বত্বভোগী ছিল তার অধস্তন মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে একজন জমিদার, সে আবার জমিদারের বা তার ঊর্ধ্বতন মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে ছিল, একজন প্রজা। নিয়মানুযায়ী, খাজনা আদায়কারী মাত্রেই ভূমিমালিক আর খাজনা প্রদানকারী মাত্রেই প্রজা। একইভাবে, অধীনস্থ রায়তদের কাছ থেকে খাজনা আদায়কারী রায়তও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একজন জমিদার। আবার, ভূস্বামী (অর্থাৎ মূল জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী) প্রধানত খাজনার আয়ে জীবনযাপন করলেও তাদের নির্দিষ্ট খাসজমিও থাকত এবং তারা সেগুলি বর্গাচাষি ও ক্ষেতমজুরের সাহায্যে চাষ করত। চাষাবাদের ধরন উল্লেখ না করে বিভিন্ন শ্রেণির দখলে ভূমির অনুপাত ছিল এরূপ জমিদারের খাসজমি ২০%, রায়তদের ৭২% ও তস্য-প্রজার ৮%।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের মতো চাষাবাদে চাষিদেরই প্রাধান্য ছিল। বেঙ্গল ভূমি রাজস্ব কমিশনের এক হিসাব অনুযায়ী কৃষক পরিবারের সদস্যদের চাষকৃত ভূমির পরিমাণ ছিল মোট ভূমির ৬৬%। অবশ্য, এ ভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ চাষ করত বর্গাদার ও ক্ষেতমজুররা। আবার, ভূমি রাজস্ব কমিশনের তথ্যানুযায়ী এ দুটি শ্রেণি যথাক্রমে ২১% ও ১৩% জমি চাষ করত। এভাবে, বিভিন্ন শ্রেণির গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে কৃষিজমি বণ্টনে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য ছিল। একদিকে, এক শ্রেণির ধনী কৃষকের অধিক জমি ছিল যা পারিবারিক ‘শ্রমে চাষাবাদ সম্ভব হতো না’। তাই তারা বর্গাদার অথবা ভাড়া মজুর নিয়োগ করত। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকের জমির পরিমাণ এত অল্প ছিল যে তাতে তাদের সকলের কর্মসংস্থান হতো না। ভূমি রাজস্ব কমিশনের অন্য একটি তথ্যে একই বিষয় সত্যায়িত হয়েছে। এভাবে, যেখানে ৫ একরের অধিক জমির মালিকদের দখলে ছিল প্রদেশের মোট জমির ২৫%, সেখানে ২ একরের কম জমির মালিকদের দখলে ছিল মোট জমির প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ (৪৬%)। উৎপন্ন দ্রব্যের অর্ধেকের পরিবর্তে বর্গাদারদের দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া উচিত এটি ছিল ফ্লাউড কমিশনের পরামর্শ। এ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ব্রিটিশ শাসনের শেষ বছরগুলিতে একটি সশস্ত্র আন্দোলন (তেভাগা হিসেবে পরিচিত) সংঘটিত হয়। কিন্তু আন্দোলন সফল হয় নি।

ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্রিটিশ শাসনামলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যাপকতর বাণিজ্যিক যোগাযোগের ফলে গ্রামাঞ্চলে অতীতের তুলনায় অধিক হারে নগদ লেনদেনের সূচনা ঘটে। বাণিজ্যিকীকরণ প্রসারে অপেক্ষাকৃত অপ্রভাবিত অঞ্চলের বা জনগোষ্ঠীর ওপরও অর্থের ব্যবহার যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অবশ্য, পরিবর্তিত পরিবেশে গড়ে ওঠা ঋণদান সংস্থাসমূহ প্রায় একচেটিয়াভাবে রপ্তানি বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ শিল্পের প্রয়োজন মিটাতে থাকায় গ্রামাঞ্চল কার্যত সংগঠিত অর্থসংস্থানের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে পড়েছিল। এভাবে, একটি অর্থনৈতিক কাঠামোর কার্যগত পদ্ধতিতে সৃষ্ট ব্যাপক শূন্যতা পূরণ করেছিল মহাজন, পাঠান, কাবুলী, ব্যবসায়ী, জমিদার ও ধনী কৃষকের মতো উত্তমর্ণরা। ১৯০৪ সালে সরকার কর্তৃক সূচিত সমবায় ঋণদান আন্দোলন খুব সীমিত সাফল্য অর্জন করে, কৃষিঋণ পায় মোট গ্রহণেচ্ছুদের এক ক্ষুদ্রাংশ (১৯৪৩ সালে ১০%)। এভাবে মহাজনরাই প্রকৃতপক্ষে ঋণের একমাত্র উৎস থাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে গৃহীত অধিকাংশ ঋণই সরাসরি উৎপাদনশীল উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হয় নি। দ্বিতীয়ত, এমনকি এসব ঋণ উৎপাদনশীল উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হলেও ব্যয়িত হয়েছে গতানুগতিক যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার ও বীজ ক্রয়ে, একর প্রতি ফলন বাড়াতে পারে তেমন কোনো উপকরণের জন্য নয়। তৃতীয়ত, উত্তমর্ণদের ধার্য সুদের হার ছিল অত্যধিক; ঝুঁকিমুক্ত ঋণের ওপর বছরে ১৮%-৩৮%, আর ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে আরও বেশি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সম্ভবত সুদের টাকার পরিমাণ জমিদারের খাজনার চেয়ে বেশি হতে শুরু করেছিল। যেভাবেই হোক, এ তিনটি বৈরী উপাদানের প্রভাবে ঋণের অর্থের একাংশ অপরিশোধিত থেকে যায় এবং পুঞ্জিত ঋণসমস্যা দেখা দেয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাংকিং তদন্ত কমিটির হিসাব অনুযায়ী ১৯২৯/৩০ সালে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকা। অন্য একটি হিসাব মোতাবেক ১৯৩৪ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল (পুঞ্জিত সুদ ব্যতীত) ৯৬ কোটি টাকা। ১৯২৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে ঋণ সমস্যা অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় কৃষি পণ্যের দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে যায় অথচ ঋণের পরিমাণ একই পর্যায়ে থাকে। এমতাবস্থায় ঋণগ্রস্ত কৃষকদের সাহায্য দানের জরুরি প্রয়োজন অনুভূত হয়। (প্রসঙ্গত, ভারত সরকারের ১৯৩৫ সালের অ্যাক্টের অধীনে কৃষকদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়।) তদনুযায়ী ১৯৩৬ সালে কৃষি ঋণগ্রহীতা আইন পাস হয় এবং এ আইনের অধীনে ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলির ঋণের পরিমাণ পরিশোধ ক্ষমতার আওতায় কমিয়ে আনতে প্রদেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত পূর্ব বাংলার কিছু জেলায় ঋণসালিশী বোর্ড গঠিত হয়। ১৯৪৪ সালের মধ্যে ঋণসালিশী বোর্ড ৫০ কোটি টাকার গ্রামীণ ঋণ ১৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনে। এদিকে, মহাজনদের ধার্য সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের অপকর্ম রোধে ১৯৪০ সালে একটি ঋণদাতা আইন (Moneylenders Act) পাস করা হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ১৯৪৫ সালে প্রদেশে কৃষি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

ব্রিটিশ আমলের শেষ পর্যায়ে প্রায় দু দশক ধরে সব ধরনের ফসল উৎপাদনে বদ্ধাবস্থা থাকাকালে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটে এবং বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে বঙ্গীয় ভূমি রাজস্ব কমিশনের (১৯৩৮) ভাষায় ‘সকল শ্রেণির মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগের শ্বাসরুদ্ধকর’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ এবং কৃষকদের চাষাধীন জমিতে তাদের মালিকানার অধিকার দেওয়া হলেও এ বদ্ধাবস্থা অব্যাহত থাকে। অতঃপর বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার বীজ-পানি-সার প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষির, বিশেষত খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটি কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলে কর্মসূচিটি আরও গতি লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে সেচপাম্প, সার ও উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

স্বাধীনতা উত্তর সময়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, সেচকৃত জমি ও উন্নত জাতের ধানের বপণকৃত ক্ষেতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। একই সময়, বিশেষত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের উত্তরসূরি) কর্তৃক প্রদত্ত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৬৭/৭০-১৯৮৫/৮৮ সালে জনসংখ্যার বৃদ্ধিহার ২.৪৮ শতাংশের পাশাপাশি সামগ্রিক শস্যের উৎপাদন মাত্র ১.৫৩% ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১.৮৯% বৃদ্ধি পেয়েছিল। গমের উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল ১৫.১% হারে। কিন্তু ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির অত্যধিক নিম্নহার (১.৯৬%) সামগ্রিক খাদ্যশস্যের বৃদ্ধিহার হ্রাস করেছে। ফলে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য পূর্ণ হয় নি। একই সময়ে (১৯৬৭-৮৮ সালে) ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন যথাক্রমে ১.৭২% ও ০.৭২% হ্রাস পায়। অন্যদিকে, পাট উৎপাদন প্রান্তিকভাবে বৃদ্ধি পায় (০.১৫%)। গত এক দশকে বাণিজ্যিক সার ও উন্নত জাতের বীজের ব্যবহার এবং সেচ এলাকার আনুপাতিক হার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে নি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, ১৯৯০/৯১-১৯৯৩/৯৪ ও ১৯৯৪/৯৫-১৯৯৭/৯৮ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন প্রায় একই পর্যায়ে (১ কোটি ৮০ লক্ষ টন) রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাচীন ও মধ্য যুগে এবং ব্রিটিশ আমলে শস্য উৎপাদন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপখাত ছিল এবং ১৯৯৭/৯৮ সালেও তাই থেকেছে সামগ্রিক কৃষির ৭২%। অন্যান্য উপখাতের অংশগুলি হচ্ছে বন (৭%), পশুসম্পদ (১০%) ও মৎস্য (১১%)। শস্য উৎপাদন উপখাতের মধ্যে ধান এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল (মোট ফসলি জমির তিন-চতুর্থাংশ)। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কৃষি আরও নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পাটচাষ সম্প্রতি হ্রাস পেয়েছে, নীট ফসলি জমি ১৯৭৩/৭৪ সালের ২ কোটি ৯ লক্ষ ৭৭ হাজার একর থেকে ১৯৯৬/৯৭ সালে ১ কোটি ৯৪ লক্ষ ১ হাজার একরে হ্রাস পেয়েছে; একাধিক ফসলি জমির পরিমাণ ১৯৭৩/৭৪ সালের ৮৪ লক্ষ ৪৭ হাজার একর থেকে ১৯৯৬/৯৭ সালে ১ কোটি ৪৬ লক্ষ ৮৮ হাজার একরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জিডিপি (GDP) বা মোট দেশীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ৬০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯৯৭/৯৮ সালে প্রায় ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।